আনিসুজ জামানের অনুবাদ করা উপন্যাস ও গ্রন্থগুলো পাচ্ছেন অমর একুশে বইমেলা – ২০২৫ তে

আনিসুজ জামানের অনুবাদ করা উপন্যাস ও গ্রন্থগুলো পাচ্ছেন অমর একুশে বইমেলা – ২০২৫ তে

১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বাঙালির প্রাণের মাস ভাষার মাস। এ মাসেই আমরা অর্জন করেছিলাম প্রিয় বাংলা ভাষা।বইমেলা শব্দটি কানে বাজলেই যে কথাটি প্রথমে মনে পড়ে সেটি হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এই বইমেলায় পেয়ে যাবেন জনপ্রিয় অনুবাদক আনিসুজ জামানের বেশকিছু গ্রন্থ। অমর একুশে বইমেলার পাঠক সমাবেশের প্যাভিলিয়নেই পেয়ে যাবেন অনুবাদক আনিসুজ জামানের অনুবাদ করা ল্যাতিন আমেরিকার কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস ও গ্রন্থ।

চলুন আনিসুজ জামানের অনুবাদ করা উপন্যাস ও গ্রন্থগুলো সম্পর্কে জানি।

কুয়ো – হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি, অনুবাদক: আনিসুজ জামান

লাতিন কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি। উরুগুয়ের এই ঔপন্যাসিকের বিশ্বনন্দিত উপন্যাস ‘এল পোসো’ (কুয়ো) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি অশরীরী। কাল্পনিক স্মৃতিতে বেঁচে থাকা কতগুলো মানুষের গল্প এটি। এর প্রধান চরিত্র লিনাসেরো একজন ব্যর্থ মানুষ, বেঁচে থাকার অনাগ্রহ থেকে সে স্বপ্ন দেখে। ওনেত্তি মার্কেস থেকে ভিন্ন এক কণ্ঠস্বর। এমনকি লাতিন আমেরিকার অন্যান্য কণ্ঠস্বর হুয়ান রুলফো, কার্পেন্তিয়ের, বোর্হেস, য়োসা কারও সঙ্গে ঠিক মেলে না। আবার এ-ও ঠিক, লাতিন সাহিত্যের ঐতিহ্য নির্মাণে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য। য়োসা যে কারণে বলেছেন: ‘লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের জন্ম উরুগুয়ের ঔপন্যাসিক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির প্রথম উপন্যাস ‘এল পোসো’ প্রকাশের পর থেকে।’ তাই ওনেত্তিকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষায় যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পাঠ ও চর্চা, সেটি অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত। 

বিমাতার গুণগান –  মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা, অনুবাদক: আনিসুজ জামান

bimatar-gunogan-book-by-anisuzzamanপেরুর শীর্ষস্থানীয় কথাসাহিত্যিক মারিও বার্গাস য়্যোসা ২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যের যে প্রভাব আজ বিশ্বসাহিত্যে লক্ষ করা যায়, তার পেছনের অন্যতম কারিগর তিনি। য়্যোসা উপন্যাসের পাশাপাশি নাটক-প্রবন্ধ লিখেছেন নানা বিষয়ে। তিনি রাজনীতি সচেতন এবং তাঁর মহাদেশের রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে সুখ্যাত। তাঁকে লাতিন আমেরিকার ‘রাজনৈতিক বিবেক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর মতো একজন রাজনীতি সচেতন সিরিয়াস লেখক যে এ রকম একটা ইরোটিক উপন্যাস লিখতে পারেন সেটি পাঠক না পড়লে বুঝতে পারবে না। ‘বিমাতার গুণগান’ ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় স্প্যানিশ ভাষায়। এই উপন্যাসে যৌনতার নীতি-নৈতিকতার সব সীমারেখা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এ রকম শিল্পিত ইরোটিক উপন্যাস লেখার ঐতিহ্য বাংলা ভাষায় নেই।

একদিকে সৎ মা ও বাবার যৌন সম্পর্কের ফ্যান্টাসি যেমন পাঠকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে তেমনই সৎ মায়ের সঙ্গে কিশোর পুত্রের অজাচার পাঠকের মনে যৌনতার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। য়্যোসা এই উপন্যাসে যৌনতার চূড়ান্ত বিবরণ ও ফ্যান্টাসি দিয়ে সমাজের যৌন চিন্তার সব মিথ যেন ভেঙে দিয়েছেন।

এই জগতের রাজত্ব – আলেহো কার্পেন্তিয়ের, অনুবাদক: আনিসুজ জামান

Ai Jogoter Rajotto Book by Anisuz Zamanআলেহ কার্পেন্তিয়ের লাতিন আমেরিকান বুম-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে ‘রিয়ালিসমো মাহিকো’ বা জাদুবাস্তববাদের অন্যতম প্রবক্তা তিনি। আফ্রো-কিউবান সংস্কৃতিকে তিনি বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক কিউবার স্বপ্ন নিয়ে ১৯২৩ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন কার্পেন্তিয়ের। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলাম লেখার কারণে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে। দেশান্তরিত হয়ে তিনি লেখেন তাঁর সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘এই জগতের রাজত্ব’।

ফরাসি উপনিবেশ হাইতিতে আফ্রিকার ক্রীতদাসদের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেন। ফরাসি উপনিবেশে ক্রীতদাসদের স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রথম সফল বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় হাইতিতে। হাইতি বিপ্লব নামে সেটি পরিচিত। এটিই একমাত্র ক্রীতদাস বিদ্রোহ, যার ফলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে ক্ষমতায় আসে সাবেক ক্রীতদাসরা। এই বিপ্লবের প্রভাব পড়ে আমেরিকায়ও, যা সর্বত্র দাসপ্রথা উচ্ছেদে অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

ফরাসি বিপ্লবকালে ক্রীতদাসদের বন্ধনমুক্তির এই ঐতিহাসিক ঘটনা কার্পেন্তিয়ের তুলে আনেন তাঁর এই উপন্যাসে। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে তো বটেই, ন্যারেটিভ রীতির অভিনবত্বের কারণেও কার্পেন্তিয়ের প্রশংসিত হন। ইউরোপীয় বাস্তববাদ থেকে সরে এসে তিনি জাদুবাস্তববাদের পরিচয় ঘটান বিশ্বসাহিত্যে। লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের স্বকীয় পরিচিতি নির্মিত হয়। এসব কারণে উপন্যাসটির পাঠ ও অনুধ্যান সমকালীন বাংলা ভাষার লেখক ও পাঠকের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।

মোরেলের উদ্ভাবন – আদলফো বিয়োয় কাসারেস, অনুবাদক: আনিসুজ জামান

আদলফো বিয়োয় কাসারেস - ‘মোরেলের উদ্ভাবন’

আদলফো বিয়োয় কাসারেস (১৯১৪-১৯৯৯) আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অনুবাদক। ১৯৩২ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাসায় বোর্হেসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। আমৃত্যু তাঁরা বন্ধু ছিলেন। দুজনেরই পছন্দের জন্রা ছিল ডিটেকটিভ ফিকশন ও ফ্যান্টাসি। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় কাসারেসের সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস ‘মোরেলের উদ্ভাবন’। বইটির মুখবন্ধ লেখেন হোর্হে লুই বোর্হেস। বোর্হেসের বোন নোরা বোর্হেস এর প্রচ্ছদ আঁকেন।

স্প্যানিশ সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির কমতির কথা উল্লেখ করে বোর্হেস বলেন, আদলফো বিয়োয় কাসারেসের মাধ্যমে স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যে এই নতুন জন্রার সাহিত্য লেখা শুরু হলো। উপন্যাসটি প্রকাশের পরপরই আলোড়ন তোলে পাঠক মহলে। ওক্তাবিও পাস, হুলিও কোর্তাসার, হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেসের মতো লাতিন সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকরা এই উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট একজন পলাতক আসামি। ন্যায়বিচার এড়াতে সে অদ্ভুত রহস্যময় এক দ্বীপে আত্মগোপন করে।

এখানে সবকিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটে। দ্বীপে পর্যটকরা আসে এবং ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আড়াল থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করে উপন্যাসের নায়ক। হঠাৎ করে পর্যটকরা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু রাতেই আবার পর্যটকদের দেখতে পায় সে। পরে বুঝতে পারে, সে যা দেখছে, যে মানুষগুলো তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কিছুই বাস্তব না। তাহলে কি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য পড়তে হবে বিশ্বসাহিত্যের এই মাস্টারপিস।

পেদ্রো পারামো – হুয়ান রুলফো, অনুবাদক: আনিসুজ জামান

বাবার সন্ধানে কোমালা নামক এক মৃতদের গ্রামে এসেছে গল্পের নায়ক। কে জীবিত কে মৃত―এমন এক ধোঁয়াশার মধ্যে শুরু হয় হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো―লাতিন সাহিত্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাসের একটি। মার্কেসের মতো পৃথিবীখ্যাত লেখক তাঁর লেখালেখির প্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসকে। তিনি বলেন, স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত সব থেকে সুন্দর উপন্যাস হচ্ছে পেদ্রো পারামো। আমি যদি এমন একটি উপন্যাস লিখতে পারতাম তাহলে আর কলম ধরতাম না। বোর্হেসের মতে, পৃথিবীর যে-কোনো ভাষায় লিখিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি পেদ্রো পারামো।

মার্কেসের মতো কার্লোস ফুয়েন্তেসও গুরু মানতেন রুলফোকে। তিনি উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেন, ‘পেদ্রো পারামো আমাদের লাতিন আমেরিকার নতুন ধরনের উপন্যাসের পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে।’ লাতিন সাহিত্যের আরেক খ্যাতিমান লেখক ওক্তাবিও পাস পেদ্রো পারামোকে নির্জনতার গোলকধাঁধা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মারিও বার্গাস য়্যোসাও স্বীকার করেছেন তাঁর প্রজন্মের ওপর এই উপন্যাসের প্রভাবকে। শুধু লাতিন আমেরিকার লেখকদের নয়, গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের অগণিত লেখক-পাঠককে বিমোহিত করে চলেছে উপন্যাসটি।

ক্ষীনকায় এই উপন্যাসটি শুধু কাহিনির জন্য নয়, কাঠামোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। রুলফো উপন্যাসের ঐতিহ্য থেকে সরে এসে তাঁর আলোকচিত্রের শিল্পকে অনুসরণ করেছেন এই উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার সবচেয়ে সফল প্রয়োগও ঘটেছে এই উপন্যাসে।

বিশ্বখ্যাত এই উপন্যাসটি মূল থেকে অনুবাদ করেছেন লাতিন সাহিত্যের একনিষ্ঠ অনুবাদক আনিসুজ জামান।

অনুবাদক আনিসুজ জামান (পরিচিতি)

আনিসুজ জামানের জন্ম ১৯৬২ সালের ২২ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার সৈয়দনগর গ্রামে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকায়। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রবাসী। প্রথমে জাপানে চাকুরিসূত্রে, পরে মেহিকোতে চাকুরিসূত্রে গেলেও অচিরেই সেখানে নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। বর্তমানে সন্তান ও স্ত্রীসহ ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ছােটবেলায় বহুভাষায় অভিজ্ঞ ও সাহিত্যরসিক নানার সাহিত্যপ্রীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

পরে মায়ের সাহিত্যপ্রীতিও অনুবাদক আনিসুজ্জামানের মনােগঠনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। মূল স্প্যানিশ থেকে তিনি লাতিন আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন লেখকের লেখা অনুবাদ করেছেন। গাব্রিয়েল গার্সিয়া। মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর-ই তাঁর প্রথম প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *