সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়তে চাইলে | আনিসুজ জামান

সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়তে চাইলে | আনিসুজ জামান

আমি মনোবিজ্ঞানী নই। দর্শনও পড়িনি। প্রেম নিয়ে যা কিছু শিখেছি, যাপনের মধ্য দিয়েই শেখা। বাষট্টি বছর ধরে বিশ্বাস, ভালোবাসা, পতন, পুনরুত্থান এবং হারানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। আমার কাউকে শেখানোর কিছু নেই। আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতার গল্পটা, বোধ ও উপলব্ধিটুকু শেয়ার করতে পারি। আমি যা দেখেছি, অনুভব করেছি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে যা খোলাসা হয়েছে, তা হলো, একটি সহজ সত্য: ভালোবাসা কোনো অলৌকিক বিষয় নয়, এটি এক ধরনের লৌকিক সম্পর্ক। প্রতিটি সম্পর্কই তৈরি হয় প্রত্যাশা, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা, সম্মান এবং চাওয়া-পাওয়ার ভারসাম্যের উপর ভিত্তি করে।

সম্পর্কের আরেক না প্রত্যাশা। যে সম্পর্কে প্রত্যাশা থাকে না, সে সম্পর্ক নিষ্প্রাণ, জড়। সম্পর্কের গল্পে একজন অন্যজনের কাছ থেকে কিছু আশা করে। মুখে না বললেও সেটা অনুভব করা যায়। আমরা কাউকে আকর্ষণীয়, হৃদয়বান, যত্নবান, শক্তিশালী বা সোম্য বলে কাছে টানি। কিন্তু সেই গুণগুলো যদি একসময় হারিয়ে যায়, সম্পর্কটাও তখন টলে ওঠে। ভালোবাসাও তেমনি—এক ধরনের অপ্রকাশিত চুক্তি। আমি তোমার পাশে থাকব, তুমি আমার পাশে থাকবে।

আমি ভালোবাসাকে মহান করে তুলতে চাই না। ভালোবাসা ক্যালকুলেটেড কিছু নয়, কিন্তু এর ভিত তৈরি করতে হলে দুটি সম্পর্কের মধ্যে পরিষ্কার বোঝাপড়া দরকার। যখন সেই বোঝাপড়া থাকে না, শুধু প্রত্যাশা থাকে, কেবল বিনিময় থাকে, তখন সম্পর্ক ভেঙে পড়ে।

কিছু সম্পর্ক সফল হয় দুজনের স্বভাব-পছন্দ, ব্যক্তিত্বের গড়ন প্রায় একই রকম হওয়ার কারণে। তারা একই ধরণের গান, খাবার, সিনেমা পছন্দ করে। তারা জাগতিক বিষয়, সন্তানের ভবিষ্যৎ, সংসার নিয়ে একইরকম চিন্তা করে। তাদের মধ্যে বোঝাপড়া এমনভাবে গড়ে ওঠে, যেন দুজন মানুষ চিন্তা করছে একজনের মতো। তবে এই ধরণের সম্পর্ক বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় দুজন একেবারেই আলাদা। সবকিছুতে বিপরীত চিন্তা করে। একজনের হয়তো খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস, আরেকজন হয়তো রাত জেগে থাকে। একজন সবকিছু প্রকাশ করে ফেলে, আরেকজনের পেটে বোম মারলেও কিছু বের হবে না। এই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ত্যাগ ও বোঝাপড়ার প্রশ্ন।

কে ছাড় দেবে? কে কাকে মানিয়ে চলবে? কে আগে সমর্পণ করবে? এগুলো একধরনের টাইমিং ও বোঝাপড়ার বিষয়। যদি সব সময় একজনই ছাড় দিয়ে চলে, তাহলে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আর ভারসাম্যহীন সম্পর্ক নিজে থেকে এগোয় না, বরং টেনে নিয়ে যেতে হয়। এই ধরনের সম্পর্ক দুজনের জন্য বোঝা হয়ে ওঠে।

আমি এমন অনেক দম্পতিকে দেখেছি, যাদের দুজনেই কর্তৃত্ব করতে চায়। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে চায় না। সংসারে জয় পরাজয়ের হিসাব কষে। এভাবে সম্পর্কের গাড়ি চলে না। দু চাকা দু দিকে টেনে ধরে। আবার এমনও দেখেছি, একজন শুরুতে অনুগত ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বদলাতে শুরু করেছে—অবচেতনভাবে। হয়তো সে বুঝতেও পারে না, কিন্তু আগের মতো আর ছাড় দিয়ে কথা বলে না। এটা তো ঠিকই, পরিবেশ, বয়স, অভিজ্ঞতা মানুষকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তন হয়তো বিপরীতের মানুষটি মানতে চায় না। তখন আবার নতুন করে ঝামেলা পাকতে শুরু করে।

মানুষ কখনো এক রকম থাকে না। যে মানুষটা আজ সর্বদা তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চায়, সে কাল হয়তো কিছুটা স্পেস চাইতে পারে। যে একদিন কোনো কিছু করার আগে অনুমতি চাইত, সে হয়তো এখন নিজের মতো করে সব কিছু করে ফেলছে। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের এই হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

তবে শুধু নির্বাক ভালোবাসলেই হয় না। ডায়লগ এগিয়ে নিতে হবে। যে কোনো সমস্যায় কথা বলতে হবে। জানাতে হবে আমি কী চাই, কী আশা করি, কী দিতে পারব আর কী পারব না। যদি তুমি চাও টকটকে লাল পাকা টমেটো—আর অন্যজন ভাবে তুমি চাচ্ছ গাজর, তাহলে শুরুতেই গন্ডগোল। অন্যজন জাদুকর নয়। না বললে সে জানবে না। না জানলে, তা পূরণও করতে পারবে না।

অনেক সময় আমরা কথা বলতে চাই, কিন্তু পরিবেশ অনুকূলে থাকে না। তখন রাগ বেড়ে যায়, আবেগ টালমাটাল হয়। আমি তখন একটা উপায় দিই, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, “৭২ ঘণ্টার বিরতি নিন”। কোনো দ্বন্দ্ব দ্বিধা তৈরি হলে তখনই একজনকে বলতে হবে: “থামো, এখন নয়, তিন দিন পর আমরা এ নিয়ে বসব।” এটা সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, রাগ প্রশমিত করে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি ও পরিণাম বিচার করার জন্য একটু স্পেস তৈরি করা। কারণ, এই তিন দিনে, জীবনের সুরে—সন্তান, কাজ, নীরবতা—সব কিছু বদলে যায়। যা গতকাল অসম্মান মনে হয়েছে, আজ তা হয়তো আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। হয়তো আজ সবচেয়ে জরুরি হলো সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। ভালোবাসাও মাঝে মাঝে একটু নিঃশ্বাস চায়।

সম্মান—এটাই হলো সম্পর্কের মৌলিক স্তম্ভ। তা সে যে কোনো ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই। সম্মান ছাড়া কোনো সম্পর্কই আনন্দদায়ক হয় না। সম্মান মানে হলো, অপরকেও তার অবস্থান ও পরিস্থিতি বিবেচনা করা, তাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা, তার অনুভূতি আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে অনেক কিছুর ঘাটতি নিয়েও, কিন্তু সম্মানের অভাবে নয়।

সবশেষে, এটা বুঝতে হবে যে এই মডেল শুধু দম্পতিদের জন্য নয়—সব ধরণের মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সন্তানদের সঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে, বন্ধুর সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে—সব জায়গাতেই প্রত্যাশা আছে, দ্বন্দ্ব আছে, তাই ত্যাগ ও শহনশীলতারও প্রয়োজন আছে।

আমি অনেক সম্পর্কের ভাঙন দেখেছি। দেখেছি কিভাবে সামান্য অহমিকার কারণে, নীরবতার কারণে প্রিয়জনরা দূরে সরে যাচ্ছে। “আমি আর আগের মতো নেই”, “আমার ভুল হয়ে গেছে”, “আমি দুঃখিত”, শুধু এতটুকু বলতে না পারার কারণেও সমস্যা ভেঙে যায়। কখনো কখনো সম্পর্কের সার্থেই দুজনের মাঝে স্পেস তৈরি করতে হয়। কারণ প্রকৃত ভালোবাসা, যতই যন্ত্রণা হোক, কখনোই কারাগার হতে পারে না।

এসব আমি বই থেকে নয়, জীবন থেকে শিখেছি। হয়তো আমার কোনো ডিগ্রি নেই, কিন্তু আছে ক্ষতচিহ্ন, স্মৃতি আর উন্মুক্ত দৃষ্টি। কেউ যদি আজ আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ভালোবাসা কী?”, আমি বলব: একটি জীবন্ত সম্পর্কের নাম ভালোবাসা। ভালোবাসা বেঁচে থাকে দুটি হৃদয়ের ভারসাম্যের উপর। ভালোবাসা বা সম্পর্ক যদি গাড়ি হয়, তার দুটি চাকা হলো দুজন মানুষ। বেগম রোকেয়া নারী আর পুরুষ বলেছিলেন, আমি এক্ষেত্রে যে কোনো মানুষ বলছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *