মুখোশ নৃত্য | আনিসুজ জামান
এতসাতলান
৮/১৮/২৪
ওরা তিনহাজার ছিল…
নিঃসঙ্গতার একশ বছর, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
মাত্র দুদিন আগে জন্ম নেওয়া ছেলেটার মুখ দেখে ওর ঠোঁটে, ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আতুর ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করছি, দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে ভায়রা ভাই হাভিয়ের। সঙ্গে বন্ধু আরনুলফো, সবাই ডাকে ‘চুপো’। হাভিয়ের বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আমাকে বগলদাবা করে আরনুলফোর জিপে তোলে। প্লাজায় যেতে হবে। তখন পুরোদমে কার্নিভাল চলছে।
অফিসের জরুরি কাজে নিউ ইয়র্ক গিয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, প্রথম সন্তানের জন্মলগ্নে পাশে থাকতে পারিনি। ছেলেটা এসেছেও সময় হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে, তা নাহলে তো টিকেট কিনে রেখেছিলাম, একদম ঠিকঠাক চলে আসতাম। তারপরও প্রচণ্ড আত্মপীড়নে ভুগেছি একদিন, সারাক্ষণ কেটেছে ছটফট করে। এখন আবার আসার সঙ্গে সঙ্গেই, কার্নিভাল, পার্টি, উৎসব! বউ আমার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘যাও, উৎসবই তো, ছেলে হয়েছে আনন্দ করবে না! আমার হয়ে দু গ্লাস তেকিলা গিলে নিও, আমাদের প্রেম ও ছেলের সুস্বাস্থ্য কামনা করে’।
এটা মধ্য মেক্সিকো। থাকি আমরা আমেরিকায়। ছেলে পেটে আসার পরপরই বউ বলেছিল–
– ওর জন্ম হবে মেক্সিকোতে।
– কেন, এখানে হলেই তো ভালো, সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট, ভবিষ্যতে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পায়ে ঠেলা উচিত নয়।
– প্রেসিডেন্ট না কচু, বয়স আঠারো হলে মিলিটারিতে নেবে আর মারতে পাঠাবে নিরীহ মানুষগুলোকে। আমি বেঁচে থাকতে তা হবার নয়।
আমি আর তর্ক করিনি। সময়ের অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওর মায়ের কাছে। ও এখানে এলে যোগাযোগ হয় খুবই কম। বাড়িতে ফোন নেই। দরখাস্ত করে রেখেছে দুবছর আগে। দিই দিই করেও দিচ্ছে না। নতুন ফোন লাইন টানতে হবে।
পোয়াতি মানুষ, ঘরে বসে থাকবে, ছেলের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভালো-মন্দ খাবে, তার আবার এত পিরিত কেন যে পাশের বাড়ি যেতে হবে ফোন করতে! অনেক দিন একান্তে কথা হয় না। কত শত কথা জমে আছে। ওদের সঙ্গে যেতে মন চাইছিল না।
প্লাজা চত্বর লোকজনে সয়লাব—কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে—সবার হাতেই কোনো না কোনো পানীয়। খানাপিনা, নাচ, গান আর প্রেম নিয়েই এই কার্নিভাল। গির্জারও বিশাল ভূমিকা এখানে। এসবের শুরু ১৫২১ সালে, এরনান করতেস ও মিশনারিদের হাত ধরে। গাড়ি চালিয়ে প্লাজা পর্যন্ত যাওয়া অসম্ভব হওয়ায় হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা তিনজন। রাস্তার দুপাশে অস্থায়ী পানীয়ের দোকান থেকে আমাকে কান্তারিতো [তেকিলা মিশ্রিত ককটেল পানীয়] কিনে দিল চুপো। এবারই প্রথম কান্তারিতো পান। মন্দ লাগছিল না—টক, মিষ্টি ঝালের সঙ্গে তেকিলার স্বাদ, মাতাল না হয়ে অনেকক্ষণ টানা যাবে।
পায়ের নিচে বড় বড় পাথর বাঁধানো ঔপনিবেশিক আমলের রাস্তা, সামনে বিশাল এক শোভাযাত্রা। বড় একটা হাফ ট্রাকের ওপর প্লাটফর্ম বানিয়ে তার ওপর সিংহাসনে বসে আছে অপূর্ব সুন্দরী রানী, এবারের রানী। পাশে মুকুট পড়া রাজা; কিন্তু দেখতে ভীষণ বিশ্রী, হোঁদল কুতকুতে দুটি চোখ, সাড়া মুখে ব্রণ, কান দুটো বেখাপ্পা রকমের ছোট, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছু নিয়েই রানীর ধারে কাছে আসারও সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু দিব্যি পাশে বসে রানীর মতোই রাস্তার দু’পাশের লোকদের দিকে চুমু ছুড়ে দিচ্ছে। রাজ্যের সভাপরিষদ বসে আছে, সবাই মুখোশ পড়া। গাড়ির সামনে মোজিয়াঙ্গা, রাস্তায় নাচতে নাচতে এগুচ্ছে। স্প্যানিশ বুঝি কাজ চালানোর মতো। ওদের ইতিহাস, সংস্কৃতি কিছুই তেমন জানি না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছি, ভায়রা ও চুপো উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
– চুপো, মোজিয়াঙ্গা কি?
– কমিক চরিত্রে ওরা কোন একটা থিম নাটকের মতো উপস্থাপন করে।
– এবারের থিম কি?
– খুব সম্ভবত মেক্সিকান বিপ্লব। মুখোশ দেখে তো তা-ই মনে হয়।
– এত দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা!
– আমরা এমনই, সবকিছু নিয়েই উপহাস করি, হাসি-খুশি, নাচ-গানের মতো উপহাসও আমাদের চরিত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। নিজেকে নিয়েও ব্যঙ্গ করতে দেখবে আমাদের।
– আচ্ছা, রানী-রাজা, ওদেরকে কীভাবে বেছে নেওয়া হলো? কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হাতের মাটির ভাঁড়ে লম্বা চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম।
– প্রতি বছরই লম্বা সময় ধরে ওদের নির্বাচন করা হয়। অনেকটা বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচনের মতোই।
– তাহলে রাজা এত বিশ্রী কেন? মুখ ফস্কে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল।
দুজনের মধ্যে ইশারায় কী একটা যোগাযোগ হলো, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আমাদের রেখে চুপো ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে। ওকে দেখে লোকজন পথ ছেড়ে দিচ্ছে। বোঝা গেল, এখানে সে বেশ প্রভাবশালী।
সে সরাসরি ট্রাকের ওই প্লাটফর্মে উঠে রাজার সঙ্গে কথা বলে হাতের ইশারায় আমাদের ডেকে নেয়। কাছে গেলে রাজা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে প্লাটফর্মে তোলে। গাড়ি খুব ধীরে চলছিল। আমার মতো দৌড়ে চলন্ত বাসে উঠে কলেজ করার ছেলের এতে উঠতে কোনো সমস্যা হয়নি। চুপো মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে বেশকিছু সময় সময় ধরে স্প্যানিশ ভাষায় অনেক কিছু বলল। ওর একেকটি বাক্য শেষ হয় আর লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ে, হাততালি দেয়। বুঝতে পারি, আমাকে নিয়েই কোনো হাসি-তামাশা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা ভালো করে বোঝার আগেই চুপোর কণ্ঠে শোনা যায়
– এখন আমরা বরণ করে নেব নতুন রাজা, যিনি বাংলাদেশি-আমেরিকান, এযাবৎ কালের সবচেয়ে সুন্দর রাজা, আনিসুজ জামানকে।
এক পরত হাসি ও হল্লার ভাঁজে বন্দী হয়ে হারিয়ে যায় আমার প্রতিরোধ। চার ফুটি সাবেক রাজা নিজের মাথা থেকে মুকুট খুলে আমার নিচু করা মাথায় পড়িয়ে দেয়। রানি উঠে এসে আমার গালে চুমু খেয়ে হাত ধরে নিয়ে ওর পাশে বসায়। চুপো ও সাবেক রাজা একসঙ্গে হাসতে হাসতে নেমে যায় প্লাটফর্ম থেকে।
আমার সুন্দরী রানি, সামনে-পাশে মোজিয়াঙ্গা, একদল ঘোড়সওয়ার পেছনে, রাস্তার দুপাশের মানুষ, সবকিছু আমাকে এক ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। জানতাম সবই এক মিথ্যে নাটক; কিন্তু এই মুহূর্তটুকু তো আর মিথ্যে নয়। অন্যদিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মিথ্যে হয়ে মুছে গিয়েছে আমার ভালোবাসা, সদ্যাগত প্রথম সন্তানের মুখ। হাত নাড়ছি, বাতাসে চুমু ছুড়ছি, শোভাযাত্রা গড়িয়ে চলছে। সারা গ্রাম ঘুরে আবার এই প্লাজা চত্বরে শেষ হবে।
গড়াতে গড়াতে শ্বশুরবাড়ির সামনে পৌঁছে যায় শোভাযাত্রা। হারামী দুটো বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে তেকিলা খাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, সাথে বাড়ির সবাই, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, জানালা দিয়ে মুখ বের করে স্ত্রীও যোগ দিল ওদের সঙ্গে। বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে। পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে, ওর তো হিংসে হবার কথা!
আমাদের যাত্রার সমাপ্তিতে দুটো ঘোড়া এসে প্ল্যাটফর্ম থেকে মঞ্চে নিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের মানুষ শীষ দিচ্ছে, হাসছে, অভিবাদন জানাচ্ছে। মঞ্চে আমাদের বরণ করে নিলেন গ্রামের প্রধান। আসন গ্রহণ পর্ব শেষ হলে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক নাচ, গান, ঘোড়ার শোভাযাত্রা, সর্বশেষে মোজিয়াঙ্গা; ওদের নাটক।
ওরা সবাই মুখোশ পড়ে নেমেছে। নাটক চলছে, সারা পৃথিবীর চিরায়ত আখ্যান, শোষিত ও স্বৈরাচারের সংঘাত। বোঝার জন্য ভাষার প্রয়োজন নেই, এই পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এক নজরেই বুঝে ফেলবে। স্বৈরাচারী লড়ছে বন্দুক কামান নিয়ে, সংখ্যায় ওরা কম কিন্তু আপাত শক্তিশালী। প্রতিপক্ষের হাতে দাঁ, কুড়াল, হাতুড়ি, কাস্তে। স্বৈরাচারী এগিয়ে আসছে, শিস বাজাচ্ছে জনগণ, আওয়াজ হচ্ছে—বুউউউ…।
বিপ্লবীরাও এগিয়ে আসছে, তালি পড়ছে, বাড়ছে উল্লাস।
হঠাৎ করেই ঈশান কোণের গির্জা চত্বর থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল, স্বৈরাচারী পুলিশ বাহিনীর নকল রাইফেল গর্জে উঠল মুহুর্মুহু। কয়েকটি পাগলা কুকুর ঢুকে পড়ল প্লাজা চত্বরে। কেন যেন হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। বিভ্রান্ত লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার রানী লাপাত্তা, পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে। বিভ্রান্ত এক রাজা দাঁড়িয়ে আছে তছনছ হয়ে যাওয়া প্লাজা চত্বরে। আশপাশের সব গাছপালা, ফুলের টব তো গেছেই, সঙ্গে প্লাজার মূর্তিও গিয়েছে কয়েকটা। মঞ্চে শুধু আমি আর নিচে অনেক বিপ্লবীর নকল লাশ। ওরা বুঝতে পারছিল না উঠবে কি উঠবে না, নাটক শেষ নাকি সবে শুরু।
পরদিন স্থানীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম এসেছিল ‘তিনশ বিপ্লবীর লাশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে নবাগত ‘রেই ফেও’।