১৮৮২ চুলের ভালোবাসাঃ আনিসুজ জামান

১৮৮২ চুলের ভালোবাসা

-আনিসুজ জামান

১৮৮২ চুলের ভালোবাসা -  আনিসুজ জামান

১৮৮২ চুলের ভালোবাসা – আনিসুজ জামান। — বসেন, সবুজ চোখ দুলিয়ে লম্বা গলা রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে ঘুরিয়ে মেয়েটা বলে।

ওর কোমর থেকে শুরু হয়ে বুকে এসে শেষ হওয়া বাঁকটা একটুও উৎকট লাগছিল না। না গুরু না সরু নিতম্ব অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঢেউ খেলিয়ে ভেতরে চলে গেল। গায়ের রংটার বর্ণনা সম্ভব নয়, মনে হচ্ছিল একটু রোদে গেলে শ্যামলা আবার কিছুদিন ঘরে কাটালে দুধ-চকোলেট হয়ে উঠবে।

পেছন থেকে ওর বুকের কম্পন আমার ভেতরে প্রতিসরণ ঘটাচ্ছিল, ৩৫ বছর পর অনুভব করেছিলাম তলপেটে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানি।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল ৯টায়। ঠিক ৯টায় দরজা ধাক্কা দিয়ে ওকে ছাড়া কাউকে না দেখতে পেয়ে আর কেউ আছে নাকি জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম। উত্তরে শুধু ওইটুকুই পেয়েছিলাম।

ওকে গিলে খাওয়া জানুসের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে গিয়ে সামনেটা দেখে আসার প্রচণ্ড লোভ কোনো রকমে দমন করতে পারছিলাম। তিন দিন আগে ফ্লোরিডা থেকে আসা কথাসাহিত্যিক-ডাক্তার বন্ধু নিশ্চিত করেই বলেছিল ক্লিনিকটা স্ট্যান্ডার্ড, তুমিও প্রসিডিউরটা করিয়ে নাও। দেশে কিছু টাকাও ঢুকুক। আমি এর আগে দুবার করালেও সামনের দিকটা ফাঁকা।

পেছন থেকে হাজার দুয়েক ডোনার পেলে পেছনের চুল সামনে এনে বড় কপালটাকে আর ঢাকতে হবে না। গতকাল ক্লিনিক দেখতে এসে বুঝতে পেরেছিলাম, আরেকটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলে, আরেকটু বিধিবদ্ধ হলে, স্বতন্ত্র কেবিন থাকলে অনেক দেশ থেকে লোক আসত শুধু চুল লাগানোর জন্য। আমেরিকায় চার ডলার, মেক্সিকোতে ১.৩ ডলার, ইস্তাম্বুলে এক ডলারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি ৫০ টাকা খুব ভালোভাবেই ফাইট দিতে পারবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে গাউন পরিয়ে প্রস্তুত করা হলো। কয়েকটি ট্যাবলেট গিলিয়ে হাতে স্যালাইন ঢুকিয়ে পিআরপি করার রক্ত নিয়ে উপুড় করে শুইয়ে লোকাল অ্যানেসথেসিয়ার সুই দিয়ে আদর করতে শুরু করার সময় আমার চোখ ঘুমে বুজে আসতে শুরু করেছে।

মাথার পেছন থেকে একটি একটি করে ডোনার তোলার শব্দ হালকা শুনতে পেলেও কোনো ব্যথা অনুভব করিনি। স্যালাইনে প্রায়ই বাথরুম চাপছিল, উঠে যাওয়ার সময় ওরা চোখ খুলে দিলে আফ্রদিতিকে খুঁজছিলাম, না পেয়ে ফিরে এসে চোখে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিলে ওকে দেখতে পারছিলাম স্পষ্টভাবে। এই সময়ের মধ্যে একটিবারের জন্যও স্ত্রীর কথা মনে পড়েনি। ওকে জানানোর প্রয়োজনটুকুও বোধ করিনি, যা আমার জন্য একেবারেই অসম্ভব। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, দৈহিক কোনো আকর্ষণ আমার এই ষাট বছরের ভিতটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হয় না।
হঠাৎ কানে এলো, আর তোলা যাবে না, ডোনার শেষ হয়ে গেছে।

—গুনে দেখো, কত হলো, সার্জন নির্দেশ দেয়।

—১৮৮২, উত্তর আসে বাম পাশ থেকে।

—ঠিক আছে, এ কয়টি লাগালেই হবে।

তখনই আমার ডান পাশে আর একটি মেয়ে এসে হাত ধরে উঠিয়ে চিত করে শুইয়ে দেয়। খসখসে শব্দে শুয়ে পড়তে বললে আমার প্রতিটি রন্ধ্র সজাগ হয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ ধরে মাথার কাছের নাসিমাসহ কেবিনের আরো তিন বেডে একই প্রসিডিউর করতে থাকা চড়ুই পাখির কিচিরমিচির থেকে এর গলা একদম আলাদা। টান দিয়ে চোখের ব্যান্ডেজ খুলে গলার মালিককে দেখার ইচ্ছাটাও সংবরণ করতে হয়। সুবোধ বালক শুয়ে পড়ে ওর আলিঙ্গনে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই তাই। ওর ডান হাত আমার বুকের ওপর থেকে সোজা উঠে কপালের গর্তগুলো ফাঁক করে তুললে নাসিমা বাঁ দিকের মেয়ের বাড়িয়ে দেওয়া ফলিকলগুলো ইরিধানের মতো করে পুঁতছিল। আমার ভাঁজ করা ডান হাতে বুক গুঁজে দিয়েছিল খসখসে গলা। ও না হয়েই যায় না। ওর সবুজ চাহনি দেখে তখনই বুঝেছিলাম। কিন্তু কেন আমার মতো বুড়োখোকার দিকে ঝুঁকবে সেটুকু জিজ্ঞেস করার মতো ফুরসত বা মানসিকতা আমার ছিল না।

‘ওর নিঃশ্বাসে কুয়াশার ঝড়, দুপাশে বিশাল দুই পাহাড়, মাঝের খাঁড়িতে ছোট্ট কোষায় একা, হাল ছেড়ে বইঠা তুলে উত্তাল পদ্মার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি, নিয়ে যাক মহাসাগরের সঙ্গমে, বিলীন হোক চরাচর।’

—আর কতগুলো বাকি?

—শদুয়েক হবে।

—নাসিমা, আমার ডান দিকে কে?

—ওর নাম শামীমা, চানপুরের মাইয়া, চান্দের লাহান ঝলমল করে, করবেই তো, ওর দুটি কোমল ঘুঘু হাতে নিয়ে নিশ্চিত হই।

—আর বামে, ভদ্রতা দেখিয়ে প্রশ্নটি না করে পারা যায় না?

—ওর নাম আলো।

—তাহলে তো হলোই, চান্দের আলো, বলি।

—না, আলো নাম অইলে কী অইব, ওর খালি কলঙ্ক।

‘হে প্রকৃতি, সময়কে থামিয়ে রাখো, এই দুশ যেন কখনই না থামে, ওর দুই পাহাড়ি ঠোঁটের মাঝের খাঁড়িতে পাথরে নোঙর ফেলে যেন এভাবেই কাটাতে পারি।’

—শেষ!

ফাঁসির পরোয়ানা ঘনিয়ে এলো। শামীমা আস্তে-ধীরে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের ওপর প্রায় ওর ঠোঁট বুলিয়ে আমাকে টপকিয়ে একবার দেখে নিশ্চিত হলো। ফেরার সময় ঠোঁটটা প্রায় বুলিয়ে দিয়েছে আমারটার সঙ্গে। আমাকে স্থির থাকতে নির্দেশ দেয় নাসিমা। একটু পরে চোখ খুললে শামীমাকে খুঁজি, চারদিকে চোখ বোলাই, ও নেই। মাথার পেছনে ব্যান্ডেজ শেষ হলে নাসিমাকে বলি শামীমাকে ডাকতে। ওদের অন্তত ধন্যবাদ তো জানাতে হবে।

দরজার দিকে তাকিয়ে আছি, প্রথমে নাসিমা ঢোকে, পেছনে—

‘ও কে’? চান্দের ঝলমলানির ঠিক উল্টো, শুধু ঠোঁট আর বুক, কোনো মানুষই অসুন্দর নয়, তবে কেন যেন বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

—স্যার, এই যে শামীমা, এই ছেরি, সামনে যা, স্যার তরে ডাকতাছে।

—নাসিমা, আলো, শামীমা এত সুন্দর করে কাজটি করার জন্য তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

—স্যার, লন, কাপড় বদলাবেন। নাসিমা তাড়া দেয়।

ওর বাহু ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে ড্রেসিংরুমে গেলে ওটায় আরেকজন কাপড় বদলাচ্ছে।

—আপনি ওই ঘরে ঢুকে বদলান, একজন আছে, কিন্তু কিছু হবে না।

ভেতরে চাদর মুড়িয়ে কেউ একজন আছে। তাড়াহুড়া না করে আস্তে আস্তে গাউন খুলে ফেলেছি, সারা দেহ সুতোবিহীন।

—মেয়েলি গলার গোঙানি

ভালো করে তাকাতে, সবুজ চোখ, মায়াবি চোখে জল ঝরছে। দ্রুত হাত দিয়ে নিম্নাঙ্গ ঢেকে জিজ্ঞেস করি কাঁদছ কেন, কী হয়েছে।

আজ ওর সুন্দর স্তন দুটো ফেলে দিতে হয়েছে। ছমাস পর ভেতর থেকে টেনে পুরুষাঙ্গটাকে সাইজ করা হবে।

—আমার পরিবারের কেউ হিজড়া চায় না। আমি মেয়ে হতে চেয়েছিলাম, মা রাজি ছিল কিন্তু বাবা ছিল না। ফুঁপিয়ে ওঠে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ 

আরো পড়ুন: আদলফো বিয়োয় কাসারেসঃ ‘মোরেলের উদ্ভাবন’ -আনিসুজ জামান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *