সালসা
-আনিসুজ জামান
সালসা – আনিসুজ জামান। সালসা শব্দটা শোনার সাথে সাথেই আমার চোখে ভেসে ওঠে কয়েকটি চিত্রকল্প যার শুরু আফ্রিকা, করে পশ্চিম আফ্রিকা; নাইজার, মালি, সেনেগাল, সেন্ট হেলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, পাঠক চমকে উঠবেন না; আপনাদের মানশ চক্ষে শব্দটির সাথে যেমন ফুটে ওঠে সল্প পোশাক (যা ওদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের অঙ্গ) পরিহিত লাতিন মেয়েরা শরীর দেখানোর কসরত করছে আর আমার মানশ্চক্ষে ফুটে ওঠে ১৫২৬ সাল। ঘোর জঙ্গল। বিভিন্ন বন্য প্রাণীর অভয়াস্থল; সারাদিন শিকারে ক্লান্ত গুঁটি কয়েক মানুষ রাতের খাবার শেষে আগুনের চারদিক ঘিরে বসে গল্প করছে। শিকারের গল্প, বীরত্বের গল্প। ওদের একজনের দুই ঠ্যাঙের মধ্যে চেপে ধরা ফাঁপা গাছের কাণ্ড কেটে তার সাথে গাছের আঠা দিয়ে শুঁকনো বন্য প্রাণীর চামড়া জুড়ে দিয়ে বানানো এক তাল যন্ত্র। গল্পের মাঝে মাঝে সে আস্তে আস্তে সেটাতে টোকা দিচ্ছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে টোকা মৃদু থেকে স্পষ্ট আর তার থেকে জোড়াল হচ্ছে। তালের সাথে সাথে সঙ্গীরাও হাতে নিয়েছে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই। কথা বলছে জোড়াল গলায়, সুরে সুরে আর রচনা হচ্ছে নতুন এক সঙ্গীত কম্পোজিশন যেটার সাথে সিংহের গর্জন ও ভয়ার্ত শিকারের ডাক মিলেমিশে দিচ্ছে এর পুরনাংগতা আর যেটা কাল আবার রচিত হবে নতুন এক কম্পোজিশন এই অপেক্ষায় হারিয়ে যাবে ওরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাবার সাথে সাথেই।
(সালসা -আনিসুজ জামান) এর পর ফুটে উঠবে ফুঁসে ওঠা মাঝ সাগরের উত্তাল তরঙ্গে উথালপাথাল এক জাহাজের খোলে শতেক কালো মানুষ লড়ছে সময়ের আর নিয়তির বিরুদ্ধে যাদের লাগানো হবে সদ্য দখলকৃত লাতিন দ্বীপগুলোতে চিনি চাষে। যেগুলো আজ পরিচিত ব্রাজিল, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, কলোম্বিয়া, পুয়েরতোরিকো ইত্যাদি নামে। দিনে ওরা চিনি চাষ করবে আর রাতে গোপনে মিলিত হবে সেই গাছের গুঁড়িটা কেন্দ্র করে। আর হবেই না বা কেন। তাল যে ওদের জীবন। ওরা শিকার করত তালে তালে, হাঁটত তালে তালে, চলত তালে তালে, বন্য কুকুরের মত।আর এখন আখ চাষও করে সেই তালে তালে আর রাতে বের করে দিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি, ক্ষোভ, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর বিপ্লবের অক্ষমতা।
অন্যদিকে ওদের অন্য ভাইদের আসতে হয়েছে পাশের ভূখণ্ড এখনকার উত্তর আমেরিকায়। ওখানেও গোপনে ওরা মিলিত হচ্ছে অন্য একটি গুরিকে কেন্দ্র করে উদ্গার করছে একই আবেগ।
ঠিক তাদেরই পাশের দ্বীপে চলছে ক্ষমতা দখলের নাটক; কিউবা। ক্রিস্থফার কলম্বাসের দাবী করা দ্বীপটি বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৯০২ সনে নামে মাত্র স্বাধীন হলেও আমেরিকার হাতের তালুতে খায় পড়ে। সমাজে তখন শুধুমাত্র দুটি স্তর যেমনটি আজও ওই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে নি। দুই স্তরের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। উপরের স্তর সপ্তাহান্তে মিলিত হয় অর্কেস্ট্রা নাচের হল গুলোতে আর নীচের স্তর মিলিত হয় পাড়ার কোনায় কোনায় সেই আদিম গাছের গুঁড়িটাকে ঘিরে যার সাথে এখন মিলিত হয়েছে কিউবার আদিবাসীদের প্রানের সুর সন মনতুনো ও গুয়াহিরা যার অর্থ চাষি মেয়ে।
উপরের স্তরের মেয়েরা সেই হলে হাতপাখা নিয়ে অর্কেস্ট্রার সুরর সাথে নাচের সঙ্গি খুঁজে বেড়ালেও কান পড়ে থাকে পাড়ার কোনায় বাজা রক্তে বান ডাকানো উন্মত্ত দ্রিম দ্রাম আওয়াজের সাথে ভেসে আশা চাষি মেয়ের হৃদয়ের আকুতি। নাচে মন বসে না ওদের আর সঙ্গী বা অভিভাবক একটু মাতাল হওয়ার সুযোগে হল থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে দুপাক নেচে আসে কাল কিউবানদের সাথে, ফেরে মাতাল হয়ে। সাদারা দেখেও দেখে না, বুঝেও কিছু করতে পারে না। সেই আদিম তালের সাথে লড়বার কোন অস্ত্রই তো ওদের নেই। তখন ১৯৫৩, বেহালা বাদক এনরিকে হররিন নিয়ে আসে এক কালোকে। সাথে আসে গুঁড়িটা, নাম তুম্বাদর। অর্থ যে ধাক্কা দেয়। সেই গাছের গুঁড়ি ওদের এমন ধাক্কা দেয় যে ধাক্কার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা কখনই। আর একবার এর ভেতর ঢুকে এর থেকে বেরুতে পারেনি গানের জগতের কেউই।
(সালসা -আনিসুজ জামান) ছেলেটা অর্কেস্ট্রার সাথে প্রথম একটি আঘাত যোগ করে আর তাতেই কমজোর অর্কেস্ট্রা নাচার প্রান পায়। নাম হয় নেওদান্সন, পড়ে চা চা চা; মেয়েদের জুতোর হিলের আওয়াজের নাম চাসে আর সেখান থেকেই উতপত্তি চাচাচা-র। পড়ে যোগ হয় অন্য এক আঘাতের। অন্য এক কালো মানুষের হাত ধরে আর জন্ম নেয় মাম্বোর। আর এমনি ভাবে পিলন, মোজাম্বিকে ইত্যাদির। কিউবার বিভিন্ন আনাচে কানাচে থেকে আসে গুয়াহিরা, চাঙ্কি, পুন্ত ইস্পিতুয়ানো, সুকুসুকো আর এ সবই সাহায্য করে হাভানার বড় বড় অর্কেস্ট্রা দলগুলোকে। একটি গাছের গুঁড়ির সাথে যুক্ত হয় আর একটি। যাদের আপনারা চেনেন কঙ্গা নামে। অর্কেস্ট্রার বাকি তালযন্ত্রগুলো পরিবর্তিত হয়ে রুপ নেয় এক সংক্ষিপ্ত অবস্থায় যার নাম তিম্বাল। ক্রমে এগুল পৌছায় আমেরিকা। বিশেষ করে নিউইয়র্কে। বিশিষ্ট অর্কেস্ট্রা বেনি মোরালেসের দলের হাত ধরে এর সাথে যুক্ত হয় জ্যাজের যেটির রয়েছে একই রকমের বিপ্লবের ইতিহাস। জন্ম নেয় সালসা। মেহিকোর এক মিশ্র চাটনির নামে।
(সালসা -আনিসুজ জামান) আমি নিজে ১৯৮৯-য়ে ঘটনাক্রমে মেহিকোর তিহুয়ানায় দেখতে যাই টিটো ফুয়েন্তেস এর উপস্থাপনা আর প্রেমে পড়ে যাই এর। সেদিন থেকেই স্বপ্ন দেখতে থাকি আমার ভাল লাগাকে আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে, বাংলায় সালসা পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ একত্রিশ বছর যাবত চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ভাবে। অনেক বড় বড় মিউজিক অরগানিজার দের সাথে। ব্যর্থ হয়েছি। সালসার আসল প্রান, যাকে ওরা সাবোর বা স্বাদ বলে সেটাই আনতে পারছিলাম না। পরিশেষে আকস্মিকভাবেই পরিচিত হই ইয়াছের-এর সাথে; কিউবা থেকে গানের উপর মাস্টার্স করা এক শিল্পীকে। ঠিক একই সময় ঘটনাক্রমে হাতে আসে কবি কাজী জহিরুল ইসলামের বিপ্লবের উপর এক সুন্দর কবিতা। ওই কবিতার অংশ নিয়ে তৈরি হয় দেশে ভীষণভাবে সমালোচিত কুৎসিত ভাষায় গালি খাওয়া গান বাংলা ভাষায় প্রথম সালসা “ মার্চ মাসের বৃষ্টি”। যেটিতে সালসার প্রধান উপকরনগুলোর সবই উপস্থিত। সালসার তাল, সুর, হারমোনি, যন্ত্র, আর সবচেয়ে উপযুক্ত বিষয় বিপ্লব। আর বিপ্লব মানেই দেশের বিপ্লব নয়, এর অর্থ হচ্ছে মুক্তির আকুতি। জীবনে যাইই আমাদের আটকে রাখে, আর তা পোশাকই হউক, সমাজই হোক বা পরিবারই হোক, তার বিরুদ্ধে প্রানের আকুতি আর সাথে ভালবাসার প্রকাশ।
আর আমি সেই সালসারই এক সরব পূজারী। আর আমার সালসা তখনই সার্থক হবে যেদিন বাংলার মানুষ এটাকে ভালবাসবে।
আরো পড়ুন: আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর