আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর

আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর

-রেজা ঘটক

আনিসুজ্জামানের অনুবাদে মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর

প্রাক–কথন:
কলাম্বিয়ার নোবেল বিজয়ী লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাথে আমার পরিচয় ঘটে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। সম্ভবত ১৯৯০ বা ১৯৯১ সালের দিকে। দুই জার্মানীর একত্রীকরণ এবং বার্লিন দেয়াল ভাঙা নিয়ে সুনীলের খুব ছোট্ট একটি প্রবন্ধের বই ‘ইতিহাসে স্বপ্নভঙ্গ’ পড়ার পর ধীরে ধীরে আমি সুনীলের লেখার ভক্ত হয়ে উঠি। সুনীলের কোনো বই পেলেই আমি তখন খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম। তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো একটি লেখা সম্ভবত ‘জাদু বাস্তবতা ও মার্কেজের গল্প’ এরকম কোনো শিরোনামের প্রবন্ধে প্রথম জানতে পারি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নাম।

সেখানে সুনীল মার্কেজের একটি উপন্যাস নিয়ে লেখার অন্তরালের ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মার্কেজ কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর অভাব আর অস্থিরতার চূড়ান্ত সময় যাচ্ছিল। পথে তাঁর মাথায় একটি বিস্ময়কর উপলব্ধি হলো। একটি উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের প্রায় প্রতিটি লাইন তাঁর মাথায় উকি দিল। বিদ্যুৎ চমকের মত তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠলো দিদিমার মুখ। ছোটবেলায় দিদিমা যখন কোনো কল্পিত শহরের গল্প বলতেন, তা মার্কেজ খুব মন দিয়ে শুনতেন এবং বিশ্বাস করতেন। দিদিমার মুখে শোনা সেসব গল্পে থাকতো ভূত-প্রেত আর অলৌকিক সব ব্যাপার স্যাপার। সেসব গল্প লিখতে হলে দিদিমার মত মুখের ভাব এনে লেখায় এমন একটা রহস্যময়তা নিয়ে আসতে হবে যাতে পাঠক ঠিকঠাক সেসব গল্প বিশ্বাস করতে পারে। বেড়াতে যাওয়া আর হলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে মার্কেজ বাড়িতে ফিরে আসলেন। বউয়ের সাথে বেদম ঝগড়া করলেন আর বললেন সংসার কীভাবে চলবে না চলবে তার গুষ্টি কিলাই। আমি লিখতে বসবো, দয়া করে আমাকে আর ডিসটার্ব করবা না। নিজের লেখার ঘরে মার্কেজ নিজেকে বন্দী করে লিখতে শুরু করলেন ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’।

সুনীলের লেখায় এরকম একটি ঘটনা জানার পর থেকে আমি মার্কেজের বই পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠি। তারপর একদিন হাতে পেলাম মার্কেজের একটি উপন্যাস। ‘সরল এরেন্দিরা ও তার হৃদয়হীনা ঠাকুরমার বিষাদময় ও অবিশ্বাস্য কাহিনী’। অনুবাদকের নামটি মনে পড়ছে না। বইটি আমি কতবার যে পড়েছি, কতবার যে বন্ধুদের আড্ডায় এর কাহিনী বলেছি, সেই হিসেব কোথাও লেখা নাই। ঠিক তখন থেকেই আমি মার্কেজের লেখারও ভক্ত হয়ে গেলাম। আর এভাবেই একদিন পেয়ে গেলাম মার্কেজের ‘সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ’-এর গ্রেগোরি রাবাসা’র ইংরেজিতে অনুবাদ ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’। বেশ কয়েকবার পড়লাম তৃষ্ণা মিটলো না। খুঁজতে লাগলাম এর বাংলায় অনুবাদ। খুব সহজে পাওয়া গেল না। একসময় কলকাতা থেকে কারো একটা অনুবাদ পেলাম (নাম ভুলে গেছি) কিন্তু পড়ে খুব একটা শান্তি পেলাম না। তারপর পড়লাম জিএইচ হাবীবের বাংলায় অনুবাদ। এটা ছিল গ্রেগোরি রাবাসা’র ইংরেজি থেকে অনুবাদ। যদিও জিএইচ হাবীবের অনুবাদ খুব সুখপাঠ্য ছিল। তবুও আমি আসলে খুঁজতেছিলাম মূল স্প্যানিশ থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ। তারপর একদিন সেটা চোখে পড়লো- বিডিনিউজ-এ তখন ধারবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল মূল স্প্যানিশ থেকে আনিসুজ্জামানের সরাসরি বাংলায় অনুবাদ। পরে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ অন্যপ্রকাশ থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

কিন্তু সময় বড় দুশমন। শেষপর্যন্ত করোনা মহামারী আসার পর আমরা সবাই যখন ঘরবন্দী, তখন আমি ফন্দি করি, এবার একটানা ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়া শুরু করব। পড়তে শুরু করলাম ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’। কিন্তু করোনা মহামারী আমাকে দিয়ে পড়িয়ে ফেললো আলবার্ট কাম্যু’র ‘দ্য প্লেগ’। একবার নয়, দু’বার নয়, তিনবারও নয়, চারবারও নয়, পাঁচবার! করোনা মহামারী যতই বিস্তার করে ততই আমি নিজের ভেতরে শামুকের মত গুটিয়ে যাই! আমি দিশেহারা! আমি উদ্ভ্রান্ত! আমি উন্মাদ! আমি পথ হারাই। আমি আমার পূর্ব-পুরুষদের নাম মনে করার চেষ্টা করি। বাবার মুখে, মা’র মুখে শোনা তাদের গল্প মনে করার চেষ্টা করি। আমি পেছনে ফিরে তাকাই। বুড়ো তলস্তয়ের গল্প পড়ি। ম্যাক্সিম গোর্কির উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি দেখি। আবার মন ঘুরিয়ে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়া শুরু করি। আবার স্তালিনের উপর ডকুমেন্টারি দেখি। আবার মার্কেজ পড়ি। আবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়ি। আবার ফিদেল কাস্ত্রো’র বিপ্লব পড়ি। আবার সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করি। আবার ঘুরে ফিরে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়ি। কিছুতেই আমি নিজেকে খুঁজে পাই না! এক মস্তবড় নিঃসঙ্গতা আমাকে পেয়ে বসে! এভাবে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়া শেষ করি। কিন্তু লেখার মত ধৈর্য আর ফিরে পাই না।

ইতিহাস:
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইটি লিখেছেন ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ সালে। আর এটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। ১৯৭০ সালে গ্রেগোরি রাবাসা এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর গোটা বিশ্বে এটি তুমুল আলোড়ন তোলে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন টাইমস-এ বইটি বেস্ট সেলার হয়। এমনকি ১৯৮২ সালে বইটির জন্য মার্কেজ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মার্কেজ কলাম্বিয়ার প্রথম এবং গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় সাহিত্যে চতুর্থ নোবেল বিজয়ী। এর আগে ১৯৪৫ সালে প্রথম ল্যাটিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হন চিলির গাব্রিয়েলা মিসট্রাল। ১৯৬৭ সালে দ্বিতীয় ল্যাটিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পান গুয়েতেমালার কবি মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল অস্ট্রিয়াস। তৃতীয় ল্যাটিন আমেরিকান হিসেবে ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী চিলির কবি পাবলো নেরুদা। আর চতুর্থ ল্যাটিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেলেন ১৯৮২ সালে কলাম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মার্কেজের পর ১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল পান আরেক ল্যাটিন আমেরিকান কবি ম্যাক্সিকোর অক্টাভিও পাস। আর ২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান আরেক ল্যাটিন আমেরিকান পেরু’র লেখক মারিও ভার্গাস লোসা! কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, যিনি একজন আমেরিকান, তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৫৪ সালে।

গল্প সংক্ষেপ:
ষোড়শ শতকের দিকে স্প্যানিশ জলদস্যু ফ্রান্সিস দ্রেক যখন রিওয়াচা আক্রমণ করে তখন উরসুলা ইগুয়ারানের পরদাদি পাগলাঘণ্টা আর কামানের গোলার শব্দে দিশা হারিয়ে জ্বলন্ত চুলার উপর বসে পড়েছিল। আগুনে পুড়ে সে এতই অসুস্থ হয়েছিল যে, একসময় সে মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তার স্প্যানিশ ব্যবসায়ী স্বামী ধীরে ধীরে স্ত্রীর চিকিৎসা আর আনন্দফুর্তির পেছনে দোকানের অর্ধেকটা ফতুর করে ফেলে। তারপর এই দম্পতি ব্যবসা লাটে তুলে সমুদ্র থেকে অনেক দূরের এক আদিবাসী লোকালয়ে গিয়ে বসতি গড়ে তোলেন।

সেই গোপন লোকালয়ে বাস করতেন দন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নামের এক আদিবাসী তামাকচাষী। এই আদিবাসী তামাকচাষী’র সাথে ওই পালিয়ে আসা স্প্যানিশ ভদ্রলোক এক লাভজনক অংশীদারি ব্যবসা শুরু করেন। এতে উভয় পরিবারের ভাগ্য ফেরে। এই ঘটনার কয়েক শতাব্দী পর সেই আদিবাসী তামাকচাষীর নাতির নাতি বিয়ে করেন স্প্যানিশ লোকটির নাতনির নাতনিকে। তিনশো বছর আগে শুরু হওয়া সেই সম্পর্কের শুরুটা নতুন করে আবার যাত্রা শুরু করে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আর উরসুলা ইগুয়ারানের বিয়ের মাধ্যমে।

কিন্তু উভয় বংশের মানুষের মধ্যে তখন একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, আদিবাসীদের সাথে বিয়ে হলে সন্তান জন্ম হলে তা হবে গিরিগিটির মত কোনো জন্তু। কারণ এর আগে উরসুলার এক খালার বিয়ে হয়েছিল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার এক চাচার সাথে। আর সেই দম্পতির একটা ছেলে জন্মগ্রহণ করেছিল, যার ছিল কুণ্ডলী পাকানো একটা লেজ, যার ডগায় ছিল বরুশসদৃশ একগোছা চুল। যা ছিল আসলে শূকরের লেজের মত। আর এটা সে সবসময় ঢিলে প্যান্টের আড়ালে লুকিয়ে রাখতো। কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখতে দেয়নি। আর বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তার এক কসাই বন্ধু হাড় কাটার কুঠার দিয়ে এই লেজ কেটে দেওয়ায় চিরকুমার অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছিল।

ওই ঘটনার পর থেকে আদিবাসী পরিবারের সাথে স্প্যানিশ পরিবারের বিয়েসাধিতে আত্মীয়রা প্রায়ই বাগড়া দিতেন। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনেকটা জোর করেই বিয়ে করেন উরসুলা ইগুয়ারানকে। কিন্তু উরসুলার মা এই বিয়েতে অভিশাপ দিয়েছিলেন আর ঘুমের মধ্যে যাতে তার স্বামী জোরপূর্বক ধর্ষণ করতে না পারে, তাই সে মায়ের তৈরি করা একটা প্রাচীনকালের প্যান্ট পরতো। আড়াআড়ি তার দিয়ে খুব শক্ত লোহার বকলেস আর ফিতা দিয়ে ওই প্যান্ট বানানো। ওই প্যান্ট খুলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যাতে উরসুলাকে ধর্ষণ করতে না পারে, তাই সে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ওই প্যান্ট পরতো। এভাবেই এই নতুন দম্পতির কয়েক মাস কাটলো।

দিনেরবেলায় উরসুলা মোরগ লড়াই দেখে আর মায়ের সাথে সেলাই করার কাজে কাটাতো। আর রাতের বেলায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া উরসুলাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে যৌনমিলনের বিকল্প ধস্তাধস্তি করে পার করতো। একসময় ওই গ্রামে একটা গুজব রটে যায় যে, উরসুলা বিয়ের একবছর পরেও এখনো কুমারী। আর তার স্বামী হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া একটা নপুংসক। এই ঘটনায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। একদিন প্রুদেনসিও আগিলার সাথে মোরগযুদ্ধে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বিজয়ী হয়। কিন্তু উপস্থিত দর্শকদের কাছে পরাজিত প্রুদেনসিও আগিলার চিৎকার করে বলে- তোকে অভিনন্দন, আর এই মোরগ তোর বউয়ের এবার কাজে লাগতে পারে, কারণ তুই তো কিছুই করতে পারোস না!

এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হাঁক ছাড়ে- তুই রেডি হ, আমিও রেডি হয়ে আসতেছি, আজই তোরে খুন করব শয়তান। ঘরে গিয়ে ধারালো বল্লম এনে বাঘশিকারে পটু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সেটা নির্ভুল নিশানায় ছুড়ে মারে। আর বল্লমটি প্রুদেনসিও আগিলার গলা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। প্রুসেনদিও আগিলার আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পায় না। মোরগযুদ্ধের মাঠে যখন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছিল, তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঘুরে ঢুকে স্ত্রী উরসুলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আর ওই ঘটনার পর থেকেই উরসুলা প্রায়ই প্রুসেনদিও আগিলার প্রেতাত্মাকে দেখতে পায়। আর ভয়ে চিৎকার করে। এই ঘটনায় একসময় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াও আর ঠিকমত ঘুমাতে পারতো না। একরাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি একটি আরশিনগরের। তাই স্ত্রী উরসুলার বুদ্ধিতে তারা এক গভীর রাতে রিওয়াচা গ্রাম ছেড়ে উল্টোদিকের পাহাড় পারি দিয়ে অনেক দূরে রওনা দেয়।

দীর্ঘ ২৬ মাস হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও স্ত্রী উরসুলা এবং তাদের কিছু বন্ধুবান্ধব তাদের বউবাচ্চাসহ পূর্বদিকে দুর্গম পর্বতমালা পারি দিয়ে এক নতুন জায়গায় নতুন বসতি গড়ে তোলেন। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যে নতুন গ্রামটির গোড়াপত্তন করেন তার নাম দেন মাকন্দ। যে গ্রামে ত্রিশ বছরের উর্ধ্বে কেউ নাই। আবার যে গ্রামে তখন পর্যন্ত কোনো কবর নেই। কারণ কেউ সেখানে তখনো মারা যায়নি। সেখানে কোনো সরকার ব্যবস্থাও নাই। আর তারা ঘোষণা দেয় তাদের কোনো ঈশ্বরেরও দরকার নাই। নিজেদের সুবিধামত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কিছু নিয়মকানুন চালু করেন। কারণ তিনিই এই মাকন্দ গ্রামের সর্দার।

আর এই দীর্ঘ অভিযানের চৌদ্দ মাসের মাথায় বানরের মাংস আর সাপের স্যুপে খারাপ হয়ে যাওয়া পেট নিয়ে উরসুলা জন্ম দেয় তার প্রথম ছেলে সন্তান হোসে আর্কাদিও। এই মাকন্দ গ্রামে একদিন বোহেমিয়ান জিপসিদের একটি দল আসে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন সব আবিস্কার করা যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা এই গ্রামে এসে সবাইকে চমক লাগিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ওই জিপসিদের একজন হলেন মেলকেদিয়াস। যিনি গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো ভারী রহস্যময় এক লোক। খুবই বুদ্ধিমান, চতুর, দারুণসব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তিনি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে নজরবন্দী করেন। একসময় মেলকেদিয়াসকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন।

নিজের সকল কাজকর্ম ফেলে তিনি ওই জিপসির বুদ্ধিতে পরশ পাথর আবিস্কারের নেশায় গড়ে তোলেন একটি গবেষণাগার। আর একদিন তিনি ঘোষণা দেন যে- পৃথিবীটা কমলালেবুর মত গোল। ওদিকে স্ত্রী উরসুলা স্বামীর এসব পাগলামীতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে শেষে সংসারের হাল ধরেন। তাদের তিন সন্তান। দুই ছেলে হোসে আর্কাদিও ও আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এবং একমেয়ে আমারান্তা উরসুলা।

হোসে আর্কাদিও বিয়ে করেন তার এক সম্পর্কিত বোন রেবেকাকে। তাদের কোনো সন্তান হয় না। কিন্তু তার যৌনসঙ্গী পিলার তেরনেরা নামের এক পতিতার গর্ভে তার একটি ছেলে হয়। যার নাম আর্কাদিও। অন্যদিকে হোসে আর্কাদিও-র ভাই কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বিয়ে করেন বেনেতা রেমেদিওস মসকোতকে। তাদের ঘরেও কোনো সন্তান হয় না। কিন্তু কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াও ওই পতিতা পিলার তেরনেরার সাথে যৌনমেলামেশা করেন। আর তেরনেরার গর্ভে জন্ম হয় তাদের ছেলে আউরেলিয়ানো হোসে।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দীর্ঘ কুঁড়ি বছর ৩২টি ব্যর্থ যুদ্ধে লিপ্ত হন। আর প্রত্যেকটি যুদ্ধেই তিনি পরাজিত হন। কিন্তু এই যুদ্ধের সময়ে জৈবিক তাড়নায় অনেকের গর্ভে একে একে আরো সতেরো জন আউরেলিয়ানোর জন্ম হয়। অন্যদিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার একমাত্র মেয়ে আমারান্তা উরসুলা কোনো এক রহস্যময় কারণে সারাজীবন কুমারী থেকে যায়। কিন্তু তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে জ্বলন্ত যৌবনের একটি অবক্ষয় দেখা যায় নিজের ভাইপো আরলিয়ানো হোসের সাথে যৌনক্ষুধা মেটানোর মাধ্যমে। হাতে কালো পট্টি বাধা আমারান্তাকে মাকন্দ গ্রামে একাকীত্বের প্রতীক মনে হলেও নিজের ভাইপো’র সাথে সে রঙ্গলীলায় মেতো ওঠে।

মাকন্দ গ্রামে আরেকটি চনমপ্রদ ঘটনা ঘটে। পতিতা পিলার তেরনেরা ও হোসে আর্কাদিও’র ছেলে আর্কাদিও নিজের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য বেছে নেয় স্বয়ং তার নিজের মা পতিতা পিলার তেরনেরাকে। ওদিকে আর্কাদিও আর তার স্ত্রী সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ-এর তিন সন্তান। আউরেলিয়ানো সেগান্দো, হোসে আর্কাদিও সেগান্দো ও রূপসী রেমেদিওস। এভাবেই গল্প এগিয়ে যায়। একে একে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের গল্প।

উরসুলা বুয়েন্দিয়ার যখন শতবর্ষ পূর্ণ হয়, তখন তিনি আর চোখে দেখতে পান না। চোখে তার ছানি পড়ে। দেয়াল হাতরে চলাফেরা করেন। মৃত্যুমুখে পতিত উরসুলা তখন উপলব্ধি করেন যে, বুয়েন্দিয়া পরিবারটি আসলে এক দীর্ঘ অভিশাপে নিপতিত। যেখানে সবাই নিঃসঙ্গতায় ভোগার পাশাপাশি রহস্যময় এক অনিদ্রা রোগের অভিশাপে জর্জরিত। এমনকি তাদের বংশপরিক্রমাটিও দূষিত রক্তের অভিশাপে চরমভাবে দূষিত। যদিও উরসুলা উপলব্ধি করতে পারেন যে, আউরেলিয়ানরা অনেকটা নির্মল মনের অধিকারী, কিছুটা উদাসীন। আবার আর্কাদিওরা অনেকটা আবেগপ্রবণ এবং উদাসী হলেও অনেক সাহসী। কিন্তু কাকতলীয়ভাবে এই বুয়েন্দিয়া পরিবারের সবাই কোনো এক অভিশাপের কারণে সবাই দুঃখজনক ঘটনার প্রতীক।

বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের গল্পটি শেষ হয় অত্যন্ত হৃদয়-বিদারক এক সামুদ্রিক ঝড়ের মাধ্যমে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় তীব্র হারিকেন ঝড়ে এই মাকন্দ গ্রামটি একসময় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের উত্থান-পতনের এক জটিল গল্প ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’। ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এর গল্পের মাধ্যমে মার্কেজ আমাদের এমন একটি কল্পিত ভূখণ্ডে নিয়ে যান, যেখানে ক্ষণেক্ষণে ঘটে চলে অলৌকিক সব ব্যাপার স্যাপার। যেখানে প্রকাশ্য দিবালৌকে চাদরে জড়িয়ে উড়ে যায় এক নারী। যিনি সৃষ্টিহীনা এক অলৌকিক সৌন্দর্যের অধিকারী। আর শেষপর্যন্ত যেখানে একটানা চার বছর এগারো মাস দুই দিন প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি আর প্রাকৃতিক অনাচারের অভিশাপে মাকন্দ গ্রামটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়া শেষ করে পাঠককে দীর্ঘক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে নির্বাক হতে হয়। এক ঘোরলাগা অলীক তন্ত্রছায়ায় বাকরুদ্ধ হয়ে কেবলই মনে হয়, ঘটনাগুলো অলৌকিক হলেও, ভূতপ্রেত বা অদেখা জাদুময়ী রহস্যে ভরা হলেও, কোথায় যেন এমন মাকন্দ গ্রামের সত্যি সত্যিই কোনো নিদর্শন ছিল। এমন কঠিন জাদুবাস্তবতায় পাঠককে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ঘোরের মধ্যে আটকে রাখেন স্থানীয়দের ভাষায় সবার প্রিয় গাবো।

উপন্যাসের বিশ্লেষণ:
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যিনি গাবো নামেই সর্বাধিক পরিচিত, তিনি ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে এমন এক ঐন্দ্রজালিক জাদুময়ী ঘটনার বর্ণনা দেন, যেখানে দেখা বা অদেখা, প্রেম অথবা অপ্রেম, পৌরাণিক বা লৌকিক, স্থানীয় বা আঞ্চলিক, বাস্তব অথবা অবাস্তব যে জনমানুষের গল্প বলেন, তা পাঠককে অনেকটা ভূতের আছর লাগার মত কঠিন আঠায় আটকে রাখে। গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় বাস্তবে এরকম কোনো ভূখণ্ডের অস্তিত্ব না থাকলেও গাবো’র জাদুময়ী বর্ণনা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা বা ক্যারিবিয় অঞ্চলে এরকম একটি মাকন্দ নগরী গড়ে তোলা সম্ভব। উপন্যাসে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ঘটনা পরিক্রমায় বারবার ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি ঘটে। বুয়েন্দিয়া পরিবারের উত্থান ও পতন যেন বারবার কেবল নিঃসঙ্গতা আর অনিদ্রায় ঘুরে ফিরে এক অভিশপ্ত বংশানুক্রমিক ইতিহাসের প্রতীক হয়ে ওঠে।

বুয়েন্দিয়া পরিবারে হোসে আর্কাদিও ও কর্নেল আউরেলিয়ানো দুই ভাই যেমন একই পতিতা পিলার তেরনেরার গর্ভে সন্তান জন্ম দেন, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মে আউরেলিয়ানো সেগান্দো এবং হোসে আর্কাদিও সেগান্দো এই দুই ভাইও আবার একই নারীর কাছে জৈবিক চাহিদা মেটাতে যায়। বুয়েন্দিয়া পরিবারের নিয়তি যেন একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি। দূষিত রক্ত আর নিঃসঙ্গতার অভিশাপে জর্জরিত গোটা বুয়েন্দিয়া বংশানুক্রিমক প্রজন্মগুলো যেন বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

কলাম্বিয়ার রেইন ফরেস্টে স্থাপিত মাকন্দ নগরীর রহস্যময় এই নিঃসঙ্গতা যেন গোটা ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক যুগের কথাই বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাজানের গহীন জঙ্গলে ও দুর্গম পর্বতমালার গহীনে অবস্থিত স্থানীয় আদিবাসী তামাকচাষী বসতিগুলো এবং স্প্যানিশদের আমেরিকা আবিস্কারের পর স্থাপিত উপনিবেশগুলোর মধ্যে শুরুতে যেমন আন্তযোগাযোগ ছিল না, তেমনি গাবো’র উপন্যাসে মাকন্দ নগরী এবং রিওয়াচার মধ্যেও কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয় না। গোটা পৃথিবী থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন এই বুয়েন্দিয়া পরিবার তাই ক্রমশ যেন নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের মধ্যে স্বার্থপর হয়ে ওঠে।

ফলে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকরা যেমন দক্ষিণ আমেরিকা শাসন করার জন্য একসময়ে বলপ্রয়োগ করে, স্থানীয়দের দাসদাসীতে পরিণত করে, কিন্তু শেষপর্যন্ত স্থানীয়দের সাথে যুদ্ধে হেরে একটি একটি করে ল্যাটিন দেশগুলোকে স্বাধীনতা দিয়ে বিদায় নেয়; তেমনি মাকন্দ নগরীর এই বুয়েন্দিয়া পরিবারটি যেন ইউরোপিয়ানদের মতই স্থানীয় ভূমির মালিক এবং অভিজাত শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তেমনি কুঁড়ি বছরে ৩২টি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, কিন্তু স্প্যানিশদের মতই সবগুলো যুদ্ধে পরাজিত হয়। ফলে আত্মকেন্দ্রিকতায় চূরান্তভাবে নিমজ্জিত আউরেলিয়ানোদের মত একই একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা দেখা যায় রেমেদিওসের মধ্যেও। রেমেদিওসের অপূর্ব সৌন্দর্যে বিমোহিত চার যুবক তার হাতে একে একে খুন হয়। ফলে গোটা উপন্যাস জুড়েই দেখা যায় আত্মকেন্দ্রিকতা ও নিঃসঙ্গতা থেকে গোটা বুয়েন্দিয়া পরিবারের কেউই শেষপর্যন্ত রেহাই পায় না।

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মাকন্দ নামে যে আরশিনগরের গোড়াপত্তন করেন, সেখানে তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, চারদিকে পানিবেষ্টিত এই নগরীতে কখনো বহিঃশত্রু আক্রমণ করবে না। বরং এই দ্বীপ নগরীর ধারণাপ্রসুত জগত থেকেই সেখানে বংশানুক্রমে একেরপর এক সব অলৌকিক ঘটনাবলী ঘটতে থাকে। আর সেসকল ঘটনাগুলো কোনো না কোনোভাবে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকেই ঘটতে থাকে। আর সেই ঘটনাক্রম থেকে বুয়েন্দিয়া পরিবার কোনোভাবেই যেমন রেহাই পায় না, তেমনি যেন তাদের মধ্যে সেই ক্ষমতাও তৈরি হয় না, যা দিয়ে তারা সেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে বারবার সেখানে ইতিহাসেরই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটে। গোটা বুয়েন্দিয়া পরিবার যেন সেই ঘটনাগুলোর আনয়নকারী, সৃষ্টিকারী কিংবা উদঘাটনকারী। আর শেষপর্যন্ত বুয়েন্দিয়া পরিবারটি যেন সেই কঠিন নিঃসঙ্গতা আর অনিদ্রার অভিশাপ থেকে কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারে না। এটাই যেন বুয়েন্দিয়া পরিবারের অমোঘ নিয়তি!

সবচেয়ে রহস্যময় আর জাদুময়ী অতিআশ্চার্য ঘটনাটি ঘটে যখন বুয়েন্দিয়া পরিবারের একজন সদস্য শতবর্ষী উরসুলার মৃত্যুর আগেআগে এই ধারণা বা উপলব্ধি হয় যে, বুয়েন্দিয়া পরিবারের কোনো প্রজন্মের কেউ একবারও বুঝতে পারে না যে, বুয়েন্দিয়া পরিবারটি একটি গোপন দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যের নিয়তিতে বন্দী। যার গূঢ় অর্থ হলো- এই পরিবারটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি অভিশপ্ত নিঃসঙ্গতা আর অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত। কারণ এই পরিবারের রক্ত আসলে বংশানুক্রমিকভাবেই চরমভাবে দূষিত।

গাবো’র ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাস জুড়েই প্রধান বিষয়বস্তুর অন্যতম গূঢ় বিষয় হলো মাকন্দ নগরীর ইতিহাসের অবশ্যসম্ভাব্যতা এবং অপরিহার্য পুনরাবৃত্তি। আর বুয়েন্দিয়া পরিবারের ও মাকন্দ নগরীর চরিত্রগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে যেন এর অতীত জীবন এবং সময়ের কঠিন চক্রের ধাবমান জটিলতা। গোটা উপন্যাস জুড়েই কাহিনীর চরিত্রগুলোর উপর ভর করে অজানা অচেনা অলৌকিক সব প্রেতাত্মা। আর এসব থেকে উদ্ভূত বা উৎসারিত ঘটনাগুলো যেন মানুষের আদিম স্বভাবগুলোরই পুনরাবৃত্তি। যা কিনা আমাদের দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসকেই চোখে আঙুল দিয়ে গাবো দেখিয়ে দেন অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে। গাবো যেন গোটা ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসকেই মেটাফরের মাধ্যমে অত্যন্ত জাদুকরী এক কৌশলে জাদুবাস্তবতার আড়ালে আমাদের পাঠ করতে আহবান করেন। উপন্যাসে সেভাবে কোনো প্রধান চরিত্র না থাকলেও সাত প্রজন্মের ঘটনাক্রম দিয়ে গাবো যেন বলতে চেয়েছেন, মানুষের মধ্যে বাস্তবিক অর্থে কখনোই কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটে না, কেবল আদিম স্বভাবগুলোই ঘুরে ফিরে বারবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। আর যার সাথে সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় গোটা ল্যাটিন আমেরিকার নৃ-তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের।

উপন্যাসের রাজনৈতিক ও কাঠামোগত পর্যালোচনা:
মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসটি যেন কলাম্বিয়ার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে সমকালীন সময়পর্বের একটি রূপক উপস্থাপন। বুয়েন্দিয়া পরিবারের মাধ্যমে গবো এখানে কলাম্বিয়ার বিভিন্ন জাতির পুরাণকথার পাশাপাশি স্থানীয় লৌকিক আচার ও প্রথাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মেটাফরিক পিন্ডের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। কলাম্বিয়ার ইতিহাসের ঔপনিবেশিক শাসনামলের উদারনৈতিক রাজনীতি, উনবিংশ শতাব্দীর পক্ষ-বিপক্ষের রাজনৈতিক মতবাদ ও তার বিকাশ, পার্বত্য এলাকায় রেলইঞ্জিনের আগমন, সহস্র দিনের যুদ্ধ-কলহ, ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির ঐক্যবদ্ধ আধিপাত্যবাদ, সরকারি মজুর নীতির কারণে স্থানীয় শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং তাদের উপর সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের হত্যাযজ্ঞ, অটোমোবাইলের আগমন, সিনেমা এবং কলাম্বিয়ার রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরা যেন অবয়ব আকারেই গাবো ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে অলৌকিকতার মোড়কে খুব কৌশলে প্রতিস্থাপন করেছেন।

উপন্যাসে মার্কেজ দুটি রঙকে অত্যন্ত কৌশলে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেখানে সোনালী এবং হলুদ রঙ বারবার ঘুরে ফিরে উপন্যাসে এসেছে। এখানে সোনালী রঙকে আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার এবং স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বর্ণযুগের সাথে তুলনা করতে পারি। যা দিয়ে আসলে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সম্পদ অনুসন্ধান বা স্থানীয় খনি সম্পদের আবিস্কারকে বোঝানো যায়। আর হলুদ রঙটি হলো জরা-মৃত্যু, ধ্বংসের প্রতীক। যেটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রচণ্ড হারিকেন ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে মাকন্দ নগরীর ধ্বংসকেই চিত্রায়িত করে।

গাবোর এই উপন্যাসকে আমরা ল্যাটিন আমেরিকার নৃ-তাত্ত্বিক দলিল হিসেবেও ভাবতে পারি। যেখানে পুরাণকথার ভেতরেই আসলে সত্যকে অনুসন্ধান করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এই উপন্যাসটি তিন ধরনের পৌরাণিক উপাদানে সমৃদ্ধ। একটি হলো- উপন্যাসের কাহিনী কালজয়ী উৎস বা শেকড় অনুসন্ধানী। দ্বিতীয়ত উপন্যাসের চরিত্রগুলো পৌরাণিক নায়কদের মত সুঠাম এবং একনিষ্ঠ। তৃতীয়ত উপন্যাসের বিষয়-আশয়গুলো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক অথবা অবাস্তব।

উপন্যাসের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গাবো যে একদল দুঃসাহসিক মানুষের পর্বতের গহীন দুর্গমে নতুন নগরী পত্তনের মাধ্যমে সেখানকার সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও কর্মময় জীবনধারার যে কার্যকারণ বর্ণনা করেন, সেখানে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যপূর্ণ যৌনতা, জৈবিক রীতিপদ্ধতি, একুগুয়েমিপনা, উদাসীনতা, একাকীত্বতা, সামাজিক দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ এবং সম্পদ অনুসন্ধানের মতো কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি সেই জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক নিঃসঙ্গতা এবং অনিদ্রা রোগের লক্ষণগুলোর সাথে ল্যাটিন আমেরিকার পৌরাণিক ও রাজনৈতিক সভ্যতা বিকাশের একটি অনিবার্য সম্পর্ক খুব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গাবো রূপক হিসেবে মাকন্দ নগরীর যে গল্পে পাঠককে জাদুর মত আটকে রাখেন, এটাই তাঁর ম্যাজিক রিয়ালিজম।

আদর্শগত বিবেচনায় মাকন্দ নগরীর বুয়েন্দিয়া পরিবার বংশ পরম্পরায় আসলে প্রেতাত্মার মতো। আর তারা শেকড়হীন বা শেকরবিচ্যুৎ এবং আদিম বসতিথেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে তারা নিজেদের আদি ইতিহাস থেকেও বিচ্যুৎ। যে কারণে এই বুয়েন্দিয়া পরিবার ও মাকন্দ নগরীর জনগোষ্ঠী ল্যাটিন আমেরিকার মূল সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তারা কিছুটা অনুন্নত এবং অলীক স্বপ্ন বা মিথ্যা মরীচিকার গর্তে হাবুডুবু খায়। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে মাকন্দ নগরীতে যে সোসাইটির গোড়াপত্তন ঘটে, সেটি এক ধরনের কুসংস্কার লালনের পাশাপাশি অলীক স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে শতবর্ষ পরে একসময় এক প্রলয় প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। যে কাল্পনিক আরশি নগরী মাকন্দকে ঘিরে গাবো’র গল্প, সেটি তাই অলৌকিক হলেও পাঠকের মনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এখানেই আমরা গাবো’র কালজয়ী জ্যোতর্ময়ী প্রতিভার দৃষ্টান্ত পাই। এখানেই গাবো ম্যাজিক রিয়ালিজম সৃষ্টি করে স্বার্থক হন।

বাংলা সাহিত্যের সাথে গাবো’র ম্যাজিক রিয়ালিজমের সম্পর্ক:
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে ধর্মাশ্রিত যে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোকে আমার কাছে সবচেয়ে বড় ম্যাজিক রিয়ালিজমের উদাহরণ মনে হয়। মঙ্গলকাব্যগুলোতে দেবতার আরাধনার পাশাপাশি দেবদেবীদের মাহাত্ম কীর্তনে যে মঙ্গল হয় এবং না করলে যে উল্টো অমঙ্গল হয় বলে যে কাব্য-আখ্যানগুলো রচিত হয়েছে, সেগুলো ম্যাজিক রিয়ালিজমের একটা বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। এমনকি এই মঙ্গলকাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয় বলে যে বিশ্বাস জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালু হয়েছিল, সেটি ঠিক গাবো’র মাকন্দ নগরীর বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্পের মতই অলৌকিক। কানাহরি দত্ত, নারায়ণদেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর কিংবা কেতকদাস ক্ষেমানন্দরা যেসব আখ্যানধর্মী মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন, তাকে আমরা বাংলা সাহিত্যের আদি ম্যাজিক রিয়ালিজম বলতে পারি।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য বিশেষ করে মনসামঙ্গল এবং চণ্ড্রীমঙ্গলকে আমরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের সাথে তুলনা করতে পারি। চাঁদ সওদাগর ও বেহুলা-লখিন্দরকে কেন্দ্র করে দৈব-লাঞ্চিত হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর যে সংগ্রামের ধারণা আমরা পাই, সেই হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর সাথে গাবো’র মাকন্দ নগরীর বুয়েন্দিয়া পরিবার ও জনগোষ্ঠীর অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলোতেও লোকায়ত সমাজের পৌরাণিক ঘটনাবলীকে চৈতন্য এবং বিমূর্ত ধারণায় যেভাবে দৃশায়িত করা হয়, তার সাথে গাবো রচিত ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের তাৎপর্যপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে।

১২শ’ থেকে ১৭শ শতকের শেষপর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের সাথে সময়ের হিসেবে ষোড়ষ শতকের ল্যাটিন আমেরিকার আদিপর্বেরও একটা চমৎকার মিল লক্ষণীয়। যে কারণে আমরা গর্ব করেই বলতে পারি, ল্যাটিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে সারাবিশ্বে যে তোলপাড়, শেকড়ের সন্ধানে গেলে বাংলা সাহিত্যের আদিতেও একই স্বরভঙ্গী, একই নিরাবেগ বর্ণনা, একই কাব্যিক আখ্যানের পরিচয় মেলে।

একই ঢঙের সুর ও স্বর বজায় রেখে আখ্যানের একেবারে শেষপর্যন্ত সেই লয়টি ধরে রাখার যে কৌশলটি গাবো ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে দেখান, সেটি আমাদের মঙ্গলকাব্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ফলে ঘটনাগুচ্ছ অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক বা অবাস্তব হলেও কাহিনী বর্ণনায় গাবো’র কৌশল এবং আমাদের মঙ্গলকাব্যের কৌশলকে একই শ্রেণিবদ্ধে ফেলা সম্ভব। ঘটনাবলী সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক হলেও চরিত্রগুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে, এই অস্বাভাবিকতাকে আমাদের অবিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না, বরং আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবধর্মী মনে হয়। বুয়েন্দিয়া পরিবারের একাগ্রতা, একাকীত্বতা, নিঃসঙ্গতার সাথে পাঠক যেভাবে ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হয়ে যায়, সেই অবিচল অসাধারণ অনুভূতি আমাদের মঙ্গলকাব্য পাঠেও সৃজন হয় বলে আমি মনে করি।

আনিসুজ্জামানের অনুবাদ প্রসঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণ:
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মূল স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলাভাষায় ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ অনুবাদ করে আনিসুজ্জামান একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ সাহিত্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি অপূর্ব সুন্দর মাইলফলক। বিদেশি যে কোনো ভাষার মূল সাহিত্য থেকে যেসব অনুবাদ বাংলাভাষায় সরাসরি করা হয়েছে, হচ্ছে বা ভবিষ্যতে করা হবে, সেই তালিকায় আনিসুজ্জামান নিজের নামটি সোনার কলমে খোদাই করে এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করলেন। এটা এমন একটি কীর্তি যা সাহিত্য সংশ্লিষ্ট যে কোনো অনুরাগীর কাজে বিশেষ করে শিল্পের কাছে এক পরম দায় মেটানোর ব্যাপার। গাবো’র মূল স্প্যানিশ থেকে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বাংলায় অনুবাদ করে আনিসুজ্জামান গোটা বাংলা সাহিত্যকেই মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।

বিশেষ করে আমরা যারা স্প্যানিশ ভাষাটি জানি না, অথচ যাদের মূল স্প্যানিশ থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হওয়া গাবো’র এই কালজয়ী উপন্যাসটি পড়ার দীর্ঘদিনের খায়েস ছিল, তাদের সেই বাসনা পূর্ণ করায় আনিসুজ্জামানকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। গাবো’র উপন্যাসের মূল স্প্যানিশ ভার্সানে সংগীতের মূর্ছনার মত আখ্যানে যে একটি ঝর্নাধারা নিরবে বয়ে চলে, সেই শ্রুতিমধুর গতিময় ধারাটি আনিসুজ্জামান অনুবাদ করার সময় অনুসরণ করেছেন বলেই আমার দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে। ফলে কোথাও কোথাও দীর্ঘবাক্যে অনেকটা জটিল মনে হলেও, গদ্যকবিতার মত সংগীতের সেই মোহনীয় সুরটি সুস্পষ্ট।

আনিসুজ্জামানের অনুবাদ কৌশলে যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, সেটি হলো- ল্যাটিন আমেরিকার পৌরাণিক ও লোকায়ত শব্দগুলোকে একেবারে আমাদের খাঁটি দেশি শব্দে রূপায়ন করায়, গোটা অনুবাদযজ্ঞে একটা নতুন সুর সৃষ্টি হয়েছে। যেটি কিনা সেই মঙ্গলকাব্যের সাথে গাবো’র ম্যাজিক রিয়ালিজমের সাদৃশ্যের মতই একটি নতুন সুরলহরীকে ইঙ্গিত করে। খাঁটি দেশি শব্দ বাছাই করায় অনুবাদকর্মটি আমার কাছে আরো আকর্ষণীয় লেগেছে। যে চমকটি আনিসুজ্জামান ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসের একেবারে শুরুর বাক্য থেকে শেষবাক্য পর্যন্ত অনুসরণ করেছেন।

গাবো যেমন ল্যাটিন আমেরিকান সংগীতের বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্রের সুর অনুসরণ করে যতিচিন্থের ব্যবহারে অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, যেমন সেমি-কোলনের ব্যবহার বলতে গেলে গোটা উপন্যাসেই অনুপস্থিত, ঠিক তেমনি আনিসুজ্জামান গাবো’র সেই মূল সুরটি অবিকল রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ফলে গাবো’র আখ্যানের মূল সুরটি বিকৃত হওয়ার ঝুঁকি থেকে আনিসুজ্জামান নিজেকে সর্বদা সজাগ রাখতে সক্ষম ছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছে। আরেকটি ইতিবাচক বিষয় আমার মনে হয়েছে যে, অনুবাদের সময় আনিসুজ্জামান বরিশালের আমড়া গাছে রাজশাহীর ল্যাংড়া আম ফলানোর প্রচেষ্টা থেকে বিরত ছিলেন। ফলে টক-ঝাল-মিষ্টি আমড়া গাছে আমড়া এবং আমগাছে আমের ফলন ঘটেছে বলেই মনে হয়েছে। যা অনেক অনুবাদকের ক্ষেত্রে জটলা পাকিয়ে যায়!

গাবো’র উপন্যাসটি গ্রেগোরি রাবাসা ইংরেজিতে অনুবাদ করার দীর্ঘদিন পর একটি সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন যে, ‘আমি এখনো অবাক বিস্ময়ে ভাবি, কোন পদ্ধতিতে অনুবাদ করলে কর্মটি সবচেয়ে ভালো হতে পারতো! দীর্ঘদিন ছাত্রছাত্রীদের বইটি পড়ানোর পর এবং গাবো’র বইটি সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি পড়ার পর, এখন যদি আমি বইটি অনুবাদের কাজে হাত দিতাম, তাহলে কী অনুবাদ আরো ভালো হতো নাকি আরো খারাপ হতো! আমরা যখন দান্তে’র নতুন নতুন ইংরেজি অনুবাদ হাতে নিয়ে ওজন পরিমাপ করার চেষ্টা করি এবং কোনো ধরনের সন্তুষ্টি ছাড়াই তা বিচার-বিবেচনা করি, তখন সেই ইংরেজি শব্দগুচ্ছের ভেতরে উকি দেন ফ্লোরেন্সের সেই অভিজাত ভদ্রলোক। যার সারমর্ম হলো- আমরা একটি বই যখন বারবার পড়ি, তখন প্রতিবারই সেটির নতুন নতুন দীগন্ত উন্মোচিত হয়’।

আনিসুজ্জামানের অনুবাদ করা গাবো’র ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইটি পড়ার পর আমারও মনে হয়েছে, আমি যদি বইটি আরো কয়েকবার পড়ার সুযোগ পাই, তাহলে বইটির আরো খুটিনাটি নাড়ি-নক্ষত্র এবং নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবো। কিন্তু মুশকিল হলো- গাবো’র কালজয়ী এই বিশাল আখ্যানকে প্রতিশ্রুত দিব্য দিয়েও বাগে আনতে পারাটা আর তা যথাযথভাবে আলোচনা করাটা আমার জন্য মস্তবড় একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। গাবো’র লেখার পঠন-পাঠন, গোটা ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে আমার স্বল্পমাত্রার জ্ঞানগরিমা কিংবা খোদ অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে বুকরিভিউ করা আমার মত সামান্য লেখকের পক্ষে সত্যি সত্যিই একটা আহম্মকের কাজ হবে বলেই আমার মনে হয়! তাই জেনেশুনে সেই ঝুঁকি নেওয়া কী বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলুন!

বইটির শুরুতে কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের একটি আলোচনা রয়েছে। যেটি বইটির অলংকারকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া বইটির শুরুতে বুয়েন্দিয়া পরিবারের বংশতালিকা সংযোজন করায় বইটি পড়ার জন্য হেল্প টুলস হিসেবে এটি কাজে লেগেছে। যদিও গাবো’র মূল বইটিতে এরকম কোনো বংশতালিকা রয়েছে কিনা আমার জানা নাই।

আমার এই লেখাটিকে আমি মোটেও বুকরিভিউ বলতে চাই না। বরং আনিসুজ্জামান অনূদিত ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ পড়ার পর আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া বা সরল অনুভূতি প্রকাশ করলাম। সুহৃদ পাঠক, আমার লেখায় কোথাও যদি অতিমাত্রার জড়তা বা পুনরক্তি অনুভূত হয়, তাহলে বুঝবেন, আমি এখনো গাবো’র সেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের ঘোর কাটাতে সক্ষম হইনি। আমি বরং আরো দীর্ঘ থেকে সুদীর্ঘ সময় ধরে এই ঘোরলাগা ঐন্দ্রজালিকতায় নিজেকে সমর্পণ করতে চাই। এমন একটি সুখপাঠ্য উপহার দেওয়ার জন্য আনিসুজ্জামানকে আমার লাল সালাম। প্রত্যাশা করি, স্প্যানিশ সাহিত্যের আরো কালজয়ী সাহিত্যযজ্ঞ আপনার হাত ধরে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় পড়ার সুযোগ পাবো। সুপ্রিয় বইপ্রেমীরা আনিসুজ্জামান অনূদিত ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইটি পড়ে আপনিও সেই ঘোরলাগায় শরিক হতে পারেন।

‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ।। স্প্যানিশ ভাষার মূল লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ।। মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আনিসুজ্জামান ।। প্রকাশক: মাজহারুল ইসলাম ।। প্রকাশনা: অন্যপ্রকাশ ।। প্রচ্ছদ: শিল্পী মাসুক হেলাল ।। বইটির দাম: ৬০০ টাকা (২৪ মার্কিন ডলার)

Source: বিডি নিউজ

সংগ্রহ করুন ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’

আরো পড়ুন: পেদ্রো পারামো’ ঘোর থেকে বের হতে পারছি না: আনিসুজ জামান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *